অভিনব মন্ডপ ভাবনা এবং প্রতিমা দিয়ে প্রতি বছর দর্শনার্থীদের মন জয় করে নেয় হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব। ৮০ বছরে পদার্পন করে এবারের থিম “তান্ডব”।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে ঘটে চলা ঘটনাবলীকেই উপস্থাপিত করা হয়েছে “তান্ডব” থিমের মধ্যে দিয়ে। থিম ও উপস্থাপনায় এটি হয়ে উঠবে মানব জীবনের একটি জীবন্ত দলিল। এই পুজো হাজরা পার্কে ( যতীন দাস পার্কের ভীতর) অবস্থিত।
হিন্দু শাস্ত্রে তান্ডবের বৈজ্ঞানিক সত্য বিশ্বতত্ব অনুসারে বর্নণা করা হয়েছে। এই মহাবিশ্বে প্রতি নিয়ত, প্রতি মুহুর্তে ঘটে চলেছে “তান্ডব”। যা অদেখা সৃষ্টি হিসাবেই লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্তরে ঘটে যাওয়া পারমানবিক অস্থিরতায় ধংস্ব ও সৃষ্টির দৈনন্দিন চক্র তৈরী হয় এবং ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে তান্ডব আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যা আমাদের অজান্তেই ঘটে চলেছে অবিরাম- অবিরত।
মহাশক্তিয তরঙ্গের ঢেউ প্রতি মুহুর্তে অনুরণিত হচ্ছে মানব শরীরে। সমগ্র মহাবিশ্ব শক্তির একক উৎস হয়ে ওঠে। আবার, সেই একক শক্তি রুপান্তরিত হয়। অর্থাৎ তান্ডব। এটি শুধুমাত্র একটি ঘটনা নয় যা একটি নির্দিষ্ট মুহুর্তে ঘটে, তান্ডব আসলে মহাবিশ্বের একটি অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, যা আমরা সাধারণত ঐশ্বরিক দৃষ্টিকোন থেকেই জানি।
হাজরা পার্কে আমাদের এই বছরের থিম জীবনের এই শক্তি কে দেখানোর চেষ্টা করেছে। এই কাজটি তার শৈল্পিক প্রয়োগে দর্শকদের কাছে নিত্যদিনের সাক্ষী হয়ে থাকবে। হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব কমিটির যৌথ সম্পাদক সায়ন দেব চ্যাটার্জী আমাদের জানান – আমাদের থিম হল জীবনের একটি ভৌত দলিল। থিমের মুল ধারনা তান্ডব, যা মূলত কোন নির্দিষ্ট মুহুর্ত নয়, বরং একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সৃষ্টি তত্ত্ব অনুসারে এই মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও হানাহানি ঘটে প্রতিদিন। মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্তরে ঘটা যাওয়া অনু-পরমানবিক সময়ে ধংস্ব ও সৃষ্টির আধার তৈরী হয়। ভবানীপুরে এই পুজো শুরু হয়, চলে কয়েক বছর ধরে, পরে এটি ১৯৪৫ সালে হাজরা পার্কে স্থানান্তরিত হয়। প্রথম থেকেই এই পুজো অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে কথা বলেছে।
যখন লাগামহীন বৃষ্টি বিস্তীর্ন চরাচর কে ধুয়ে দেয়, তখন পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলি গৃহহীন দের জন্য নতুন আবাস হিসাবে আবির্ভূত হয় যারা প্রকৃতির উন্মত্ত রুপের সামনে তাদের অবিরাম চেতনা ছাড়া সব কিছু হারিয়েছে। ঝড় যখন ধংস্বযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতি এবং মানুষের জীবন কে একই ভাবে ধংস্ব করেছে। এটি একটি সম্পূর্ণ মানব সভ্যতার অবক্ষয় ঘটায় এবং একটি আধুনিক সমাজ কে তার আঙুলের ছোঁয়ায় ধংস্ব করার ক্ষমতা দিয়ে যায়।
গত তিনটি বছর ধরে আমরা করোনা অতিমারীর বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই করে এসেছি। আক্ষরিক অর্থেই সে মানব জীবন কে ধ্বংস করে, চালিয়েছে “তান্ডব”। হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব কমিটি চায় সেই তান্ডবের দিন শেষ হোক। মা এর আশিস বর্ষিত হোক সবার জীবনে।
হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব সম্পর্কে : হাজরা পার্কের পুজোর একটা নিজস্ব তাৎপর্য ও গৌরব রয়েছে। একটা সময় ছিল যখন দুর্গা পুজো প্রধানত উচ্চবিত্ত ও উচ্চবর্নের পরিবারের বাড়িতে হত। নিম্নবর্গের লোকদের এই পুজোতে প্রবেশাধিকার ছিলনা এবং দেবীর প্রসাদ থেকেও তারা ছিল ব্রাত্য।
এই সুবিধাবঞ্চিত ভানুষের জন্য পুজোর আনন্দ উপভোগ করা কল্পনার বাইরে ছিল। পারিবারিক পুজো গুলো ধীরে ধীরে “বারোয়ারী” পুজোয় বদলে যাচ্ছিল কিন্তু “সর্বজনীন” বা ধর্ম নিরপেক্ষ হয়ে উঠতে দীর্ঘ পথ বাকি ছিল। সেই সব দিনে হরিজন / মেথর দের অপবিত্র বলে মনে করতো কারন তারা কোলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের খোলা গর্তের ল্যাট্রিন এবং শহরেরে পয়ঃনিস্কাশন ব্যাবস্থা পরিস্কার করার জন্য নিযুক্ত ছিল এবং তাই পুজো প্যান্ডেল গুলিতে তাদের প্রবেশ সীমাবদ্ধ ছিল।
১৯৪২ সালে তৎকালীন মেয়র শ্রী কে সি দাস ও শ্রী সুভাষ চন্দ্র বসুর নির্দেশনায় কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের সহায়তায় এই পুজো শুরু হয়েছিল। এই পুজোয় সাধারন জনগন, সুবিধাবঞ্চিত, অনগ্রসর শ্রেনী এবং হরিজনদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এর আগে এই পুজো ভবানীপুরে অনুষ্ঠিত হত। ১৯৪৫ সালে এই পুজো হাজরা পার্কে স্থানান্তরিত হয়। অনগ্রসর শ্রেনীর মানুষ পুজোয় অবাধে অংশগ্রহণ করতে পারতো, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। আজও, ঐতিহ্য হিসাবে, প্রায় ১০০০ জন হরিজন উপবিষ্ট এবং ব্যাক্তিগতভাবে কমিটির সদস্যদের দ্বারা ভোগ ও প্রসাদ বিতরন হয়।