আজ বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা স্বর্গীয় আনুপ কুমারের জন্ম বার্ষিকী। দ্যা ইন্ডিয়ান ক্রনিকেলসের তরফ থেকে রইল একটি বিশেষ প্রতিবেদন ।
অনুপ কুমার , বাংলার বিখ্যাত কমেডি বা কৌতুক অভিনেতা হিসাবে আমরা যাকে জানি তাকে আমরা অনেকেই প্রায় ভুলতে বসেছি। আজকের প্রজন্ম কি আদৌ চেনেন ? জানেন এই শিল্পি সম্পর্কে ? আজকে যারা বাংলা চলচ্চিত্রের মূল কাণ্ডারি হয়ে বাংলা ”ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি” চালাচ্ছেন তারা বাংলা চলচ্চিত্রের সেই সাদা কালো পর্দার সোনালি দিনের অমুল্য অভিনেতা অভিনেত্রী দের জন্য কততুকুই বা করেন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা আজ খুব স্বাভাবিক তবে আজ থাক সেই বিতর্ক।
পরাধীন ভারতে ১৯৩০ সালের ১৭ই জুন জন্ম গ্রহন করেন অনুপ কুমার। আসল নাম সত্যেন দাস । মূল নিবাস ছিল হুগলীর পান্ডূয়ায়।মা বিজয়া দেবী ও পিতা ধিরেন্দ্র নাথ দাস ছিলেন নজ্রুল গীতি শিল্পি ও সুরকার । পিতা বেতারে কর্মরত হওয়ায় তাদের চলে আসতে হয় উত্তর কলকাতায়। সেই সময় অনুপ কুমার পরতেন কলকাতার ডাফ স্কুলে । বর্তমানে এই স্কুল এখন শুধুমাত্র নারী শিক্ষা কেন্দ্র হয়ে গেছে।
বাড়িতে সঙ্গীত চর্চার সাথে সাথে যাতায়াত ছিল বিভিন্ন নাট্য ব্যাক্তিত্তের। সেখান থেকেই অভিনয় জগতের দিকে মন যায় ছোট্ট অনুপ কুমারের। ১৯৩৮ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে, ধীরেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলির পরিচালনায় ”হাল বাংলা” চলচ্চিত্রে তার প্রথম অভিনয় শুরু তার পর সেখান থেকেই তিনি অভিনয়ের শিক্ষা গুরু হিসাবে পেয়ে যান শিশির কুমার ভাদুড়ি কে।
এরপর হঠাৎ করেই পিতা ধীরেন্দ্র নাথ দাসের বেতারে চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়ে যাওয়ায় সংসারে নেমে আসে চরম আর্থিক সঙ্কট। ৫ ভাই বোন এর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন মাত্র ১৪ বছর বয়সে। মাট্রিকুলেশন পাশ করার পরেই পেশাদারি অভিনয় করতে শুরু করেন অনুপ কুমার। অভিনয় করার স্বার্থেই নিজের নাম বদলে সত্যেন দাস থেকে করেছিলেন অনুপ কুমার। ১৯৪১ সালে পেশাদারি মঞ্চে ” টিপু সুলতান” নাটকে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন। এর পর থেকে শ্রী রঙ্গম, বিশ্বরুপা , কাশীবিশ্ব নাথ মঞ্চে শুরু হয় নিয়মিত অভিনয় করা। অনুপ কুমার খুব কম করে ৫০ টি নাটকে পেশাদারি অভিনয় করেছিলেন তার মধ্যেয় উল্লেখযোগ্য হল – শ্যামলী, নুরজাহান, কনে বিভ্রাট, অঘটন, হটাত নবাব, জয় মা কালী বোর্ডিং, রাম শ্যাম জদু ও চন্দন পুরের চোর । নাটকে অভিনয় করতে করতেই তিনি তার বাকি ৪ ভাই বোনের পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে দেন। শুধু মাত্র অর্থনৈতিক কারনেই তিনি নাটক বা চলচ্চিত্রের কাহিনি খুব বেশি বাছাই করতে পারতেন না যে যেমন কাজের সুযোগ দিতেন তেমনই করতেন । অভিনেতা অনুপ কুমার দরদী মানুষ হিসাবেও ছিলেন এক অনন্য ব্যাক্তি। ছোট থেকেই নিজের সন্সারে অর্থনৈতিক অনটন দেখেছিলেন বলে নিজের সহকর্মী থেকে সাধারন মানুষের পাশে আপদে বিপদে সব সময় পাশে থাকতে চেষ্টা করতেন। সেই সময় বন্যা ত্রানের জন্যও বেশ কয়েকবার পথে নেমে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন অনুপ কুমার। এছারাও স্বর্গীয় পরিচলাক মৃণাল সেনের স্ত্রী ছিলেন অনুপ কুমারের মামাতো বোন, মৃণাল সেন তখন সদ্য চাকরি ছেড়ে পরিচালক হিসাবে নানান জায়গায় চেষ্টা করছিলেন তখন বেশ কিছু বছর মৃণাল সেনের সংসার টেনে ছিলেন অনুপ কুমার । যদিও মৃণাল সেনের কোন ছবি তেই অনুপ কুমার কে কোন দিন দেখা যায়নি। অনুপ কুমারের এই দরদি মন হওয়ার কারনে অনেকেই সেই সময় তাকে নানা ভাবে ব্যাবহার করলেও অনুপ কুমার কোন দিন তার প্রতিবাদ করেননি।
কালক্রমে তিনি নিজেকে একজন অন্যতম বিশিষ্ট কৌতুকশিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অভিনয়ে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি হিন্দি সিনেমা ও ‘যাত্রাপালা’য় অভিনয় করেন। ১৯৪৮ – ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সাথেও যুক্ত ছিলেন “নিমন্ত্রণ” ছায়াছবিতে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক ছবির অভিনেতা হিসাবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ছায়াছবিতে মূলতঃ পার্শ্বচরিত্রে তার অভিনয় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কয়েকটি ছবিতে অবশ্য নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি কমেডি চরিত্রে অভিনয় করে বহু ছায়াছবিকে ইতিহাসেরপাতায় স্থান করে দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য সেই সমস্ত ছায়াছবিগুলি হল
‘বসন্তবিলাপ‘,’মৌচাক‘,’দাদারকীর্তি‘,’প্রতিশোধ্,’বরযাত্রী্’কানামাছি’,’পলাতক’ ,’বালিকাবধূ’,’নিমন্ত্রণ’,’অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’
‘শহর থেকে দূরে’
হিন্দি সিনেমা-‘চন্দ্রশেখর’,’কিতনে পাস কিতনে দূর’, পরিবর্তন’
অনুপকুমার ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে “পলাতকা” ছায়াছবিতে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসাবে ‘বিএফজেএ’পুরস্কার পান। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে স্টার থিয়েটার থেকে পান রূপার পদক। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি পুরস্কার পান ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে। শিরোমণি পুরস্কারের ভূষিত হন ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে। ‘দীনবন্ধু পুরস্কার’ পান ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের স্বীকৃতি পান।
দ্যা ইন্ডিয়ান ক্রনিকেলসের তরফ থেকে রইল স্বর্গীয় অনুপ কুমারের প্রতি শ্রধাঞ্জলি ।