কলেজের পাঠ শেষ করেই শখের বশে চলচ্চিত্র জগতে আসা। মানিক বাবু থেকে রাজ চক্রবর্তীর সাথে কাজ করার দীর্ঘ ৩৭ বছর বাংলা চলচ্চিত্র জগতে কাটিয়ে ফেললেন, পরিচালক প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী। ফোনে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এলো বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্রের হাল হকিকত।
পরিবারের চোদ্দ পুরুষের কেউ কোন দিন চলচ্চিত্র জগতে না থাকা সত্বেও, নিজের আগ্রহ থেকেই শুরু করেন সিনেমা পাড়ায় যাতায়াত। প্রথম থেকেই ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের মেইনস্ট্রীমে কাজ করার। কিন্তু নিজের আগ্রহ থাকাটাই তো শেষ কথা নয়, তারজন্য প্রেমেন্দু দা কেও বেশ বেগপেতে হয়েছে অন্যদের মতোই, তবে সে সব নিয়ে প্রেমেন্দু দার কোন আক্ষেপ নেই, বরং এটাই স্বাভাবিক। ততকালীন সময়ে বর্তমান যুগের মতো যোগাযোগ ব্যাবস্থা এতো সহজ ছিলনা। স্টুডিওতেই থাকতো বিভিন্ন পরিচালকদের ঘর। সেখানে সেই সব পরিচালকরা একটা নির্দিষ্ট সময় আসতেন, ঘন্টার পর ঘন্টা ষ্টুডিওতে বসে অপেক্ষা করা, তাদের সাথে দেখা করা, তাদের সাথে আলোচনা করাটাই ছিল অনেক বড় একটা ব্যাপার। ঠিক তখন থেকেই প্রেমেন্দু দার স্বাধীন চলচ্চিত্রের প্রতি ঝোঁক ছিল।
কলেজ জীবনেই আলাপ হয়েছিল পরিচালক অঞ্জন দাসের সাথে, তখন তিনি একটি মাত্রই সিনেমা করেছিলেন যার নাম সেনিক। সেই সময় তিনি আর বড় কোন সিনেমা করছিলেন না, ব্যাস্ত ছিলেন শর্টফিল্ম এবং নানা রকম গবেশনামূলক কাজ নিয়ে এবং সেখান থেকেই পরিচালক অঞ্জন দাসের সাথে প্রেমেন্দু দার কাজ করার শুরু। প্রথম দিকে কখনও লেখালিখি করে আবার কখনও পরিচালনায় সহযোগিতা করে, নতুন হবার সুবাদে নির্দিষ্ট কোন দায়িত্ব না থাকলেও সব রকম ভাবে সহযোগিতা করাই ছিল প্রেমেন্দু দার মূল দায়িত্ব। তার পরেই আলাপ হয় পরিচালক রাজা সেনের সাথে। তখন তিনি “একটি জীবন” নিয়ে কাজ করছেন। সেই সময় প্রেমেন্দু দা “একটি জীবন” এর পোষ্ট প্রডাকশনের কাজে রাজা সেনের সাথে কাজ করার সুযোগ পান।
বর্তমানে সেলুলয়েডের পরিবর্তে ডিজিটাল মাধ্যমে কাজ করার সুবিধা অসুবিধা প্রসঙ্গ ওঠায় প্রেমেন্দু দা জানালেন – ” আমরা কাজ শিখেছিলাম সেলুলয়েডে, সেখানে কাজ করতে গেলে অনেক ভেবে চিন্তা করে একটা শট নিতে হত। একটু ভুলের জন্য লেগেযেত অতিরিক্ত ফিল্মরোল ফলত বেড়ে যেত ফিল্ম মেকিংএর বাজেট যার ফলে তখন অভিনেতা অভিনেত্রী থেকে অনান্য কলাকুশলীরা Sorry বলতেন কারন সেলুলয়েডে ডিসিপ্লিন বা একটা নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে কাজ করতে হত বিশেষ করে পরিচালক ও ক্যামেরাম্যান বা ডিওপি-র মধ্যে কিন্তু এখন ডিজিটাল মাধ্যেমে কাজ করাটা আগের থেকে অনেক সহজ বা জনপ্রিয়। এখানে খরচা কমেছে ফিল্ম মেকিং এর। ফলত এখানে কেউ ভুল করলে এখন কার Sorry টা হয়েছে ভীষন সস্তা যা আগের টা ছিল ভীষন দামী। এখানে ডিসিপ্লিনের অভাব। এখন কাজের প্রতি মানুষের ধারনাটা একেবারেই অন্যরকম। সবাই ভাবে সিনেমা বানানো টা পৃথিবীর সব থেকে সহজ কাজ বা ফটোগ্রাফি করাটা একটা সহজ কাজ। চাইলেই যে কেউ করতে পারে। এটার জন্য যে একটা ট্রেনিং নেওয়া দরকার বা যারা ট্রেনিং নিয়েছেন তারাই এটা পারেন তা নয়। এখন মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেই মানুষ ভাবে ফটোগ্রাফি করে ফেলছেন। এখন মানুষ কোন কিছু না জেনে, না শিখে চলে আসছেন সিনেমা করতে যা সব থেকে খরচা সাপেক্ষ একটি মাধ্যম। এমনকি মানিক বাবুকেও সিনেমা করার আগে সেটে বসে সিনেমা তৈরীর প্রত্যেকটা প্রসেস জানতে বা শিখতে হয়েছে, তিনি দীর্ঘদিন ফিল্ম সোসাইটির মধ্যে থেকে ফিল্ম মেকিং নিয়ে চর্চা করেছিলেন। তারপর তিনি ফিল্ম তৈরী করতে শুর করেন। চিত্রবানীর স্টুডেন্ট হবার সুবাদে মানিক বাবুকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। চিত্রবানীর কোর্স ডিজাইন থেকে ছাত্রছাত্রীদের ছবির প্রদর্শনী সব টাই মানিক বাবু খুব স্নেহৃের সাথে দেখতেন।
বিগত ৩৭ বছর ধরে প্রেমেন্দু দা কাজ করেছেন অঞ্জন দত্ত, কৌশিক গাঙ্গুলী, অপর্না সেন, শেখর দাস থেকে শুরু করে রবি কিনাগী ও রাজ চক্রবর্তীর সাথেও। সকলের সাথেই কাজ করে নানা ভাবে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। সকলের কাছেই জেনেছেন ফিল্ম মেকিং এর ভিন্নধর্মী কৌশল। তবে মেইনস্ট্রিম ছবি পরিচালনা করার সময় তিনি গুরু হিসাবে স্মরন করেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের প্রখ্যাত পরিচালক প্রভাত রায় কেই। তার সাথে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রেমেন্দু দাকে আজও অনুপ্রাণিত করে।
আসলে মুল জায়গা টাই হলো দর্শকদের কাছে পৌছানোর, যা একটি শৈল্পিক ধারার ভীতর দিয়েও বিনোদন করা যেতে পারে আবার কেউ তার নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী বিনোদনের একটা অন্যমাত্রা দিয়ে থাকেন। কিন্তু যখন বিনোদন একটা শৈল্পিক ধারার ভীতর দিয়ে দর্শকের কাছে যায় সেটা একটা শিক্ষনীয় ব্যাপার। কিভাবে দর্শক কে কমিউনিকেট করবো সেটা কাউকে অ্যাসিস্ট না করলে, ফ্লোরে না থেকে শেখা সম্ভব না। আমার ভালো লাগা বা আমার মনে হওয়াটাই দর্শকের ভালো লাগবে তা নাও হতে পারে। এছাড়া পরিচালক হয়ে অভিনেতা অভিনেত্রী দের থেকে কি ভাবে কাজ টাকে বের করে আনতে হবে এটাও শেখার যা বই পড়ে শেখা যায়না। এখনকার অধিকাংশ সিনেমাতেই এটার ভীষন অভাব দেখা যায়। কারন অভিজ্ঞতা ছাড়াই কেউ সিনেমা করবো ভেবে একটা সিনেমা করে সেন্সর সার্টিফিকেট পেয়ে গেল মানেই কি সেটা সিনেমা হল? রসবোধ ছাড়াই কেউ একটা গল্পের বই নিজ তাগিদে ছাপলেই সেটাও যেমন বই নয় এখানেও ব্যাপারটা একই। সেটা সিনেমা না বই সবটাই বলবে দর্শক।
কমার্শিয়াল আর সেমি-কমার্শিয়াল চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে প্রেমেন্দু দা বললেন, সব চলচ্চিত্রই কমার্শিয়াল। অনেকেই বলেন আমি ফেস্টিভ্যাল মুভি তৈরী করছি কিন্তু আসলে মুভির জন্যই ফেস্টিভ্যাল হয়। একটা হয় মেইনস্ট্রিমের জন্য আর একটা নন মেইনস্ট্রিম বলা যেতে পারে। মেইনস্ট্রিম মুভি বা চলচ্চিত্র দেখার দর্শক সকলেই হতে পারেন। একজন অটো চালক থেকে বাজারে যে মাছ মাংস বা সব্জি বিক্রি করছেন। তারা কিন্তু এন্টারটেইনমেন্টের জন্য মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে হাজার টাকা খরচা করে দেখতে পারবেন না। তারাই আজ মেইনস্ট্রিম চলচ্চিত্র দেখা বন্ধ করেদিয়েছেন। সেখানে আমি ভালগারও দেখাতে পারি আবার শিক্ষনীয় কিছু দেখিয়েও বিনোদন করতে পারি। কিন্তু শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মাল্টিপ্লেক্সে গায়ে পারফিউম মেখে হাতে দামী পপ-কর্ন নিয়ে সিনেমা দেখার দর্শকের সংখ্যা কম এবং ব্যবসায়িক সাফল্য স্বাভাবিক ভাবেই কম। তপন সিনহা, তনু বাবু ও উত্তম কুমারের ছবি কিন্তু মেইনস্ট্রিম ছিল যা নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা সকলে দেখেছে। তাদেরকে কমিউনিকেট করার জন্যই কমার্শিয়াল চলচ্চিত্র বা মুভির দরকার। সব ছবিই কমার্রশিয়াল। আর্ট মুভির প্রযোজকও লাভের মুখ দেখতে চান।
কলকাতা বাসী চায় ভালো কন্টেন্ট। একটা সময় তারা ভালো কন্টেন্ট পায়নি তারা দেখতে চায়নি। আজ তারা আবার ভালো কন্টেন্ট পাচ্ছে তাই তারা আবার দেখছে, সেখানে তারা স্টারডাম ও দেখছেন না। এই সময় দুটি সিনেমা বাজারে দারুন ভাবে চলছে একটি হলো দোস্তজী আর একটি হল বল্লভ পুরের রুপ কথা। এই দুটি ছবির দুই পরিচালকের একজন অভিনেতা তাই তার অল্প পরিচিতি আছে আর একজনের কোন পরিচিতি নেই তার পরেও হলে সেই দুটি চলচ্চিত্র রমরমিয়ে চলছে। তার আগে অনিক দত্তের অপরাজিত বাংলা ছাড়াও বাইরেও স্টারডাম ছাড়া ভালো চলছে।
সুতরাং বাঙালি যেখানেই থাক, তারা ভালো কন্টেন্ট পেলে নিশ্চয়ই দেখবে। এখন আমি যদি একটা পচা মাল কে শুধুমাত্র প্রচার মাধ্যমে ভালো বলে চালানোর চেষ্টা করি তাতে একবার দেখবে দুবার দেখবে তারপর আর দেখবে না।
এবং দীর্ঘদিন ধরে ভীষন পচা পচা ছবি প্রচার মাধ্যমে এবং সোস্যাল মিডিয়াতে দারুন ভালো বলে বাঙালি কে বোঝানো হয়েছে পরে তারা হরে গিয়ে দেখেছেন কিছুই নেই। আর এই প্রকোপটাই এখন চলছে। সেক্ষেত্রে মানুষ যদি হলে গিয়ে দেখে বলে ভালো তখন আর প্রচারের অপেক্ষায় থাকেনা। তখন মানুষ নিজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রচার করে। তবে এখন অধিকাংশ মানুষ এই ধরনের প্রচার মাধ্যমের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন। আর রইলো রাজনৈতিক প্রভাব সেটা সিনেমা তে প্রছন্ন ভাবে থাকেই। সেটা সিনেমার রাজনীতি। দলীয় রাজনীতি সিনেমায় এসে পড়ে তাহলে সেটা খারাপ হবে। তবে দলীয় রাজনীতি যে আজ সিনেমা তে এসেছে তা নয়। বহু বছর বহু ভাবে অনেক আগেই এসেছে। সিনেমার ওপর যে চাপটা সেটা শুধু রাজনৈতিক নয় সেন্সরশিপের চাপ ও। যদি এই সেন্সরশিপের চাপ না থাকতো তাহলে বহ সিনেমার এন্ডিং অন্যরকম হতো। সিনেমা একটা শক্তিশালী মাধ্যম সেখানে এই প্রভাব আগেও ছিল আগামীতেও থাকবে এবং পৃথিবীর বহু জায়গায় এটা হয়েছে। তবে শিল্পী ও শিল্পের স্বার্থে কোন রকম হস্তক্ষেপই কাম্যনয়।
আগামী দিনে প্রেমেন্দু দার দুটি নতুন ছবি মুক্তিপেতে চলেছে। সামনেই আসছে “পলাশের বিয়ে ” অভিনয় করেছেন মিমি চক্রবর্তী, সোমরাজ, অলোকনন্দা রায় , রজতাভ, অঞ্জনা বসু, বিশ্বজিত চক্রবর্তী সহ অনেকে আর তার পরেই আসবে “লাভ ম্যারেজ” যেখানে আবার দীর্ঘদিন পরে দেখা যাবে রঞ্জিত মল্লিক কে। সাথে অপরাজিতা আঢ্য, অঙ্কুশ, ঐন্দ্রিলা, সোহাগ সেন সহ অনেকে।