Soumen D : শারদ উৎসবের আর খুব বেশি দেরি নেই। এই মুহূর্তের সব থেকে বেশি ভাইরাল নিউজ হল আমাদের চারিপাশে নামি দামি দুর্গা পুজো কমিটির খুঁটি পুজোর খবর। খুঁটি পুজোর নির্ধারিত দিনের আগে থেকেই চলতে থাকে বেশ কিছু বিশেষ আয়োজন। পাড়াতে পুজো কমিটির সদস্যরা হয়ে পড়েন আয়োজনে ব্যাস্ত। পুরোহিতের কাছে জেণে নেওয়া হয় বিশেষ দিন ও তার সময় । আমন্ত্রণ করা হয় এলাকার বিত্তশালী ব্যবসায়ী , প্রভাবশালী ব্যাক্তি থেকে শুরু করে নামি দামী অভিনেতা অভিনেত্রীদের ।
কিন্তু বছর ১২/১৪ আগে এই খুঁটি পুজোর তেমন অস্তিত্ব ছিল না । থিম পুজো শুরু হবার সাথে সাথেই এই খুঁটি পুজোর আবির্ভাব। কিন্তু এই খুঁটি পুজোর অতীত বা ইতিহাস কি ? থিম পুজোর আগে আমরা সেই অর্থে খুঁটি পুজোর কথা শুনিনি। আসুন জেনে নেওয়া যাক খুঁটি পুজোর ইতিহাস।
প্রতি বছর রথযাত্রার দিন হয় বেশিরভাগ পুজো প্যান্ডেলের খুঁটি পুজো। যারা এদিন পুজো করতে পারেন না, তারা চেষ্টায় থাকেন পরের অন্যান্য শুভ দিনগুলিকে বেছে নিতে। খুঁটি পুজোর ধারনাটি এসেছে প্রায় শত বছর পুরনো এক রীতি থেকে। তৎকালীন সময় সব পুজোই হত সাবেকিয়ানা। রঙিন কাপড়ে কুঁচির কাজ আর খুব বেশী হলে প্যান্ডেলে বাটামের কাজ আর তার সাথে ছিল চন্দন নগরের লাইট । সেই দেখতেই বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়তো কারণ থিম বা সাবেকিয়ানা নয়, বাঙালী আনন্দে মেতে ওঠে ঊমার আগমনে। ঊমা অর্থাৎ মা দুর্গা কে বাঙালী তার ঘরের মেয়ে হিসাবেই পূজা করে । বছরে মেয়ে ঊমা কৈলাশ থেকে মর্তে তার সন্তান সহ বাপের বাড়ী আসেন মাত্র ৫ দিনের জন্য আর তাতেই মর্তবাসী আনন্দে মেতে ওঠেন। তাই ঊমা আসার আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। পাড়ায় পাড়ায় ঊঠে যেত ব্যানার । তখন এতো ফ্লেক্সের ব্যানার হত না । কাপড়ের ওপর সাইন বোর্ড আর্টিস্ট কে দিয়ে লেখানো হত এই ব্যানার। পাড়ার সব থেকে ঊচূ দুটি বিপরীত মূখী বাড়ীড় ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে শূন্যে ঝুলিয়ে বাধা হত সেই ব্যানার। মাঝে মাঝে দু- একটা পটকা বাজীও ফাটানো হত। মাস টীণ-চার আগে থেকেই হত এই ব্যানার তোলার কাজ। তার কিছু দিনের মধ্যেই ছাপানো হত “হ্যান্ডবিল” । সেই হ্যান্ডবিলে থাকতো গত বছরের পূজোর আয় ও ব্যয়ের হিসাব ও তার সাথে নতুন পূজো কমিটি মেম্বার দের পরিচিতি , আর সেই হ্যান্ডবিল পাড়াড় কচি কাচা দের মাধ্যমে পৌছে দেওয়া হত এলাকার প্রতিটি বাড়ী আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলিতে। এসব করার অর্থ ছিল এলাকা বাসী কে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে বোলা কারণ কিছুদিনের মধ্যেই চাঁদার বিল বই হাতে পূজো কমিটির সদস্যরা তাদের বাড়ী বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলিতে হাজির হবেন চাঁদা আদায়ের জন্য।
এখণ সে সব কিছুই অতীত । বাঙালীর তথা বাঙলার সেরা উৎসব এখণ কর্পোরেট কোম্পানি আর রাজনৈতিক নেতা দের দখলে। এখণ আর শুধু ব্যানার তোলা হয়না। যথারীতি ঘটা করে করা হয় খুঁটি পূজো। হিন্দু শাস্ত্রে খুঁটি পুজোর ঊল্লেখ সেই অর্থে কোথাও নেই । তবে যে কোন পূজো শুরু করার আগে ভীত পূজো বা জমি কে বিশেষ করে পূজো করার ঊল্লেখ আছে যুগ যুগ ধরে। তার সাথেই দেবরাজ ইন্দ্র কে সেই দিন পুজোর মাধ্যমে আমন্ত্রণ ও সন্তুষ্ট করা হয় কারণ যাতে ঐ পুজোর জমিতে কোন প্রাকৃতিক বা ও অ- প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা না ঘটে। তার সাথেই এই দিন এখানে আমন্ত্রিত থাকেন নেতা মন্ত্রী থেকে শিল্পপতি ও বীশীষ্ট অভিনেতা অভিনেত্রীরা এবং অবশ্যই কিছু সাংবাদিক দের দল। কর্পোরেটের দখলে চলে যাওয়া বাঙালীর শারদ উৎসবের সূত্রপাত বা শুভারম্ভ এখণ হয় এই ভাবেই । এই দিনেই মোটামুটি ঘোষণা করা হয় এবছরের সেই পুজোর থিমের শিল্পী কে , কিসের আদলে বা থিমের বিষয় বস্তু । এই দিন থেকেই শুরু হোয়ে যায় শারদ উৎসবের প্রতিযোগিতা । আর এখণ থেকেই শুরু হোয়ে যায় কর্পোরেট কোম্পানি গুলির থেকে মোটা অঙ্কের স্পন্সরশীপ বা চাঁদা আদায়।
এক সময় বাঙালির এই দুর্গোৎসব ছিল একে বারেই পারিবারিক উৎসব। কিন্তু ক্রমেই অর্থের অভাব অনটনে সেই পারিবারিক পুজো এখন বারোয়ারি অর্থাৎ বারোজনের পুজোয় পরিবর্তিত হয়েছে।
এই ভাবেই মানুষের বিবর্তনের সাথেই বাঙালির শারদ উৎসবের পরিবর্তন ও শুরু হয় খুঁটি পুজোর সুত্রপাত। আগামী দিনেও হয়তো শারদ উৎসব আরও নতুন কিছুর সাথে শুভারম্ভ হবে আর বাঙালি তখন খুঁটি পুজোর নস্টালজিয়া তে ডুবে থেকে স্মৃতি রোমন্থন করবে।