ভারতের সচেতন গণতন্ত্র প্রিয় মানুষের কাছে এ যেন ত্রাহ্যস্পর্শ যোগ পরিস্থিতি। কেন্দ্রের শাসক বিজেপি ও তাদের সরকার যে গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলোর উপর আঘাত হানছে তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। কিন্তু বিকল্প কে বা কারা? পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রকে বাঁচাতে কাদের উপর বাজি ধরবে ভারতবাসী?
উপরের ওই দুটো প্রশ্নের উত্তরের মূল্য এখন কোটি টাকা। দেশের প্রধান বিরোধী দল এখনও পর্যন্ত যে জাতীয় কংগ্রেস এই নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু এটাও পরিষ্কার, অসমুদ্র হিমাচল কংগ্রেসের সেই আগের প্রভাব আর নেই। একা কংগ্রেস বিজেপির মোকাবিলা কোনভাবেই করতে পারবে না। তাকে আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে হাত মেলাতেই হবে। আর এখানেই এসে যাচ্ছে বিজেপিকে হারানোর প্রশ্নের সবচেয়ে জটিল সমীকরণের বিষয়টি।
ভারতের বেশিরভাগ আঞ্চলিক দল, যারা বিজেপি বিরোধী তাদের বিরুদ্ধে ভুরিভুরি দুর্নীতির অভিযোগ অভিযোগ বললেও ভুল হবে এই পরিমাণ অভিযোগ আছে। এই দলগুলো এমন সব কাণ্ডকারখানা ঘটিয়েছে যে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মানুষরাও বিশ্বাস করে তাদের দ্বারা সেই দুর্নীতি হয়েছে। ফলে ওই আঞ্চলিক দলগুলির নেতারা সেই দুর্নীতির শাস্তি পাক, আইন মেনে তাদের সাজা হোক এটাও চায় মানুষ।
আর মানুষের এই চাহিদাটাই বিজেপির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এই সমীকরণেই ২৪ এর জাতীয় নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের জন্য বাজিমাত করতে চাইছে গেরুয়াশিবির। এই দ্বিধাবিভক্ত পরিস্থিতিটা বোধহয় ভালই টের পাচ্ছে বাংলার মানুষ। বিজেপি ভারতীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে এটা যেমন সত্যি, তেমনই আঞ্চলিক দলগুলির ভাবমূর্তি সম্বন্ধে এই অভিযোগও ততটাই সত্যি।
পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ মানুষ এখনও বিজেপি বিরোধী। একই সঙ্গে এই রাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতি, গরু-কয়লা পাচারের জাল যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাতে যেভাবে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের নাম প্রতিনিয়ত উঠে আসছে তাতে বিরক্ত শুধু নয়, বরং অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে বাঙালি। তৃণমূলের হোমরা চোমড়া নেতারা জেল খাটছে। আরও বড় বড় নেতাদের গারদে পাঠানোর দাবি তুলছেন অনেকে। ঠিক এমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তেলেঙ্গানা, দিল্লি, বিহারের মত রাজ্যে। বিরোধীরা ক্ষমতার না থাকলেও মহারাষ্ট্রেও বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক দলে একই অবস্থা।
পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। এ রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দল বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেস। তারা খাতায়-কলমে জাতীয় দল হলেও মূলত যে আঞ্চলিক দল সে নিয়ে কোনও সংশয় নেই। বিজেপিকে হারানোর প্রশ্নে তাদের ভূমিকা বাংলায় যে অপরিসীম সেটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব বহু মানুষ। আর ঠিক এই ব্যাপারটাকেই হাতিয়ার করে ২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল বিরোধী জনমতকে নিজেদের দিকে টেনে আনতে চাইছে বিজেপি। এর জন্য তাদের হাতে থাকা সিবিআই-ইডি’কে প্রয়োজনমত যথেচ্ছ ব্যবহার করতেও পারে। এই কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির অপব্যবহার নিঃসন্দেহে ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করছে। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলি যেভাবে দুর্নীতির পাঁকে জড়িয়ে গিয়েছে তাতে ইডি-সিবিআই’র এই অতি সক্রিয়তায় অন্তত আমজনতা ততটাও ভুল কিছু দেখছে না।
সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিষয়টা বিচার করলে বোঝা যাবে যে কেন মানুষ কেন্দ্রীয় এজেন্সির এই অতি সক্রিয়তা নিয়ে বিশেষ একটা ভাবিত নয়। দেশের গণতন্ত্র রক্ষা সবচেয়ে বড় ব্যাপার। কিন্তু প্রতিদিন যে মানুষটা দুটো রোজগার করে কোনরকমে সংসার চালান তাঁর জীবনে দুর্নীতির প্রত্যক্ষ প্রভাব অনেক বেশি। ফলে তিনি মোটেই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলগুলির দিকে থাকতে চাইবেন না বলেই মনে। এই ভয়ঙ্কর দুর্নীতির দোষে দুষ্ট হয়ে পড়েছে তৃণমূল কংগ্রেস, ভারত রাষ্ট্র সমিতি, আম আদমি পার্টি, ওআইএসআর কংগ্রেস, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি, ন্যাশনাল কনফারেন্সের মত দেশের প্রথম সারির বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি।
প্রথম সারির আঞ্চলিক বিরোধী দলগুলি যদি এইভাবে দুর্নীতির পাঁকে নিজেদের নিমজ্জিত করে না ফেলত তবে চাইলেও বিজেপি এত সহজে ইডি-সিবিআই’কে ব্যবহার করতে পারত না। কারণ তাতে জনসমর্থনই উল্টো কথা বলত। এক্ষেত্রে বলা যায়, আঞ্চলিক দলগুলি নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে নিজেদের জেলাযাত্রা ঠেকাতে আঞ্চলিক দলগুলির নেতৃত্বের একাংশ বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছে বলেও অভিযোগ উঠছে। খোদ কংগ্রেস শিবির থেকেই এই অভিযোগ তোলা হয়েছে বেশিরভাগ আঞ্চলিক দলের বিরুদ্ধে।
এই পরিস্থিতিতে একমাত্র বোধহয় ব্যতিক্রম দেশের বামপন্থী দলগুলো। তাদের বিরুদ্ধে সেইরকম বড় কোনও দুর্নীতির অভিযোগ নেই। তাও কেরলে সোনা পাচার সংক্রান্ত যে দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে তদন্ত হচ্ছে সেটাতেও সিপিআই(এম) নেতৃত্ব একেবারে হাত তুলে নিয়েছে। পরিষ্কার বলেছে, যে অভিযুক্ত তাকে ধরবে এজেন্সি। এতে পার্টির কোনও আপত্তি নেই।
দুর্নীতির অভিযোগে কংগ্রেসেরও বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে সক্রিয় কেন্দ্রীয় এজেন্সি। কিন্তু তারপরও কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বকে ঠিক কাবু করতে পারেনি গেরুয়া শিবির। তাতে যে বিজেপিকে ঠেকানোর প্রশ্নে দেশের বিরোধীরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে এমনটা নয়। বরং পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, রাজ্যের রাজ্যে বিজেপিকে ঠেকাতে হলে দুর্নীতিগ্রস্ত আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে হাত মেলাতে হবে কংগ্রেসকে! এমনটা হলে জনসমর্থন গেরুয়া শিবিরের দিকেই হেলে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা অনেক বিশেষজ্ঞের।
ভোট কারবারীদের অনেকেই আক্ষেপ করে বলছেন, কংগ্রেস এবং বামপন্থী দলগুলো যদি আরও শক্তিশালী হত তাহলে দেশের গণতন্ত্র নিয়ে এই ভয়ঙ্কর প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়াতে হত না ভারতবাসীকে। সেক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত আঞ্চলিক দলগুলোকে বাদ দিয়েই কংগ্রেস ও বামেরা হাত মিলিয়ে ২৪ এর লোকসভা ভোটে বিজেপিকে কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারত!
সত্যি বলতে ২৪-র ভোটের আগে বিরোধী শিবির অত্যন্ত সঙ্কটে।