বৈশালী মণ্ডলঃ মূলত কলকাতার বনেদী অঞ্চলেই বাবুদের উত্থান ঘটেছিল। বাগবাজার শোভাবাজার চিতপুর এসব এলাকার জমিদার বা ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে বাবুদের আবির্ভাব।
ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে আন্দাজ করা যায় সাধারণের পক্ষে বাবু হওয়া সম্ভব ছিল না। তা হতে গেলে কুকুরের বিয়েতে লাখ ৮ টাকা খরচ করতে হয়। চার ঘোড়ায় টানা গাড়ি হাকিয়ে ভেঁপু বাজিয়ে গঙ্গাস্নানে যাওয়া দু একটা রক্ষিত রাখা তাদের বাড়ি বানিয়ে দেওয়া কবুতর ওড়ানো বাইজিদের আসরে বসানো ইত্যাদিও করতে হতো এসব পাল্লা দিয়ে করতে গিয়ে অনেকেই সর্বশ্রান্ত হয়েছে। কিন্তু যার এসব সৌখিনতা করার সামর্থ্য ছিল না সে আর যাই হোক বাবু হতে পারত না
হুতুম প্যাঁচার নকশা ১৯ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার বাবু কালচার এবং বাংলার অবক্ষয়িত সমাজ জীবনের এক অসাধারণ ও জীবন্ত দলিল গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে সমকালীন কলকাতার সমাজ জীবনের দুর্নীতি কপটতা ও ভন্ডামীর বিরুদ্ধে শানিত ব্যঙ্গ বিদ্রুপ।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী এবং গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে আসা জমিদাররা যে বিলাসবহুল এবং ব্যাপন দাড়ি সংস্কৃতি সূচনা করেছিল তা হুতুমের নকশা গ্রন্থে বাবু সংস্কৃতি নামে ফুটে উঠেছে।
হুতুম প্যাঁচার নকশা গ্রন্থে কলকাতার বিভিন্ন সংস্কৃতি লেখক তুলে ধরেছেন যেমন নীলের ব্রত গাজনে সন্ন্যাসী যাত্রা গান বুলবুলের গান, আখড়াই , হাফ আখড়াই ইত্যাদি। আবার মদ্যপানে সংস্কৃতি ও কলকাতার বাবুসামাজে তখনকার দিনে বেশ প্রচলিত ছিল।
উনিশ শতকে ইংরেজের আগমনে এই কলকাতার বুকে যে পরিবর্তন উত্থান ও পতন ঘটেছিল তা কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতোম প্যাঁচার গ্রন্থে বেশ ভালোভাবে উপস্থাপিত করেছেন এই সময় বাঙালিরা ইংরেজের অনুকরণে কখনো কখনো প্রাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেছে নানা ভাবে তারা সাহেবিয়ানার প্রকাশ ঘটিয়েছে।
রাত কত হলো??
কখনো কখনো উত্তর মিলত না। বড় ঘড়ির কাটার ঢং ঢং করে আওয়াজ করছে। একে একটা প্রহর গড়ালো, প্রভাতের কপালে সূর্য ঘরে ফিরল না বাবু
তখন বাবুদের ছিল বাইজি বাড়ি হাতিয়ে কব্জিতে বেল ফুলের মালা জড়িয়ে আতর মেখে গিলে করা পাঞ্জাবি আর চুরিদার ধুতি পরে তারা বাইজিদের বাগানবাড়িতে যেত।
তাদের এক হাতে থাকতো ধুতির খুঁঁট অন্য হাতে থাকতো সাদা রুমাল অথবা হাতির দাঁতের বাটলার ছুরি সবাই ছিল মেজাজি, ইয়ার দোস্ত নিয়ে টাকা উড়িয়ে মদ মাংস খেয়ে গভীর রাতে নেশায় ভূত হয়ে তবেই বাড়ি ফিরত কখনো কখনো বারাঙ্গনা বা বিশ্বস্ত ভিত্তকে নিজের আঙ্গুলে হীরের আংটি খুলে দিয়ে দিত। কেউ দেখে যেত বাইজিদের সঙ্গে লখনৌ বা বেনারস থেকে আনা হতো বিখ্যাত বাইজিদ আজতো সারেঙ্গী সানাই জলসা চলতো রাতভর বাদ্যযন্ত্রে বাধতো কখনো মালকোষ বাকেন্দ্রী বা দরবারি কানাড়া বারাঙ্গনাদের দেওয়া হতো মোহর বেনারসি ও অন্যান্য মূল্যবান উপহার। বৈঠকখানায় ঝুলত বেলেবাড়ি ঝাড় তাতে জল তো বিদেশ থেকে আনা মোমবাতি। এগুলোই ছিল বাবু কালচারেরই অংশ।
কালীপ্রসন্ন সিংহের কথায় বাবু মাত্রই ধনী কিন্তু ধনী হলেই বাবু হয় না রাম দুলাল সরকারের টাকা ছিল কিন্তু বাবু হয়নি তিনি অতি দরিদ্র থেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনী হয়েছিলেন খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। রাম দুলাল দুবেলা নিরামিষ পেতেন দুপুর বেলা ভাত দুধ আর দু একটি মিঠাই আর রাতে আটার রুটি, খুব সাধারণ পোশাক পড়তেন নিজের ছেলের বিয়েতে তিনি শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কয়েক দিনের জন্য একজন প্রহরী কে নিয়োগ করেন সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত রামদুলাল সাধারণ বেসে বিবাহ সংক্রান্ত কাজ দেখাশোনা করতে গিয়ে কাজ শেষে পুরনায় গৃহে প্রবেশ করতে চাইলে প্রহরটি রাম দুলালকে চিনতে না পেরে পথ রোধ করে কারণ ধনী লোকদের জীবন যাপন এত সাধারন হতে পারে প্রহরী ভাবতেই পারিনি।