তাঁরা শিবের উপাসক। তাঁদের বংশের সাথে জড়িয়ে আছে মনসামঙ্গলের চাঁদসদাগর। তাই হয়তো তাঁদের ঘরে দুর্গাও একা আসেন না, সঙ্গে আনেন সৃষ্টির আরেক শক্তি মহাদেবকে। এ রীতি বরাবর শুরু থেকেই চলে আসছে এ বাড়িতে। শুরু বলতে ১৯০৫ সাল, স্থান না কলকাতা নয় বারাণসী। তখন অর্থাৎ যে সময়ের কথা বলছি, তখন প্রায় সব বাঙালিরই দ্বিতীয় গন্তব্য ছিল কাশী। ফলে সে সূত্রে বারাণসীর সাথে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল চাঁদ সদাগরের অনুপ্রেয় এই পরিবারের। সেখানেই প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। উদ্যোগ ছিল মূলত ভোলানাথ দত্ত এবং পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র রঘুনাথ দত্তের। এই ভোলানাথ দত্তের নামানুসারেই পরে তাঁদের কলকাতার বাসস্থানের নাম হয় ‘ভোলানাথ ধাম”। এই দত্ত পরিবার মূলত গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। ফলে বিভিন্নরকম মশলার কারবারির কারণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বাসস্থানও পাল্টাতে হয়েছে এঁদের, সেই সূত্রে পালটে গেছে দুর্গাপুজোর স্থানও।
বারাণসীর পাট চুকিয়ে এ রাজ্যে দত্ত পরিবারের আদি নিবাস গড়ে ওঠে বীরভূম জেলায়। তারপর সেখান থেকে বর্ধমান। এর কিছুকাল পর এই দত্ত পরিবার কলকাতার সুতানটী অঞ্চলের গোলক দত্ত লেনের একটি বাড়িতে বসবাস করা শুরু করেন, এবং আবারও এর সাথে সাথে এই বাড়িতে ধুমধাম করে দুর্গাপুজোর আয়োজন শুরু করা হয়। এই সময়ে পরিবারের ব্যবসা মশলা থেকে সরে আসে কাগজের দিকে। সে সময়ে ছাপার কাগজের চাহিদা ছিল প্রবল, সাথে জনপ্রিয় ছিল মুদ্রণ ব্যবসাও। ফলে ছাপার কাগজের পসারও সে যুগে নেহাত ফ্যালনা ছিল না, কলকাতার বুকে ব্যবসায়িক জমিদারিত্ব অর্জন করতে।
এরপর ১৯২২ সালে বিডন স্ট্রিট অঞ্চলের বাড়িটি রঘুনাথ দত্ত কিনে নেন ছবি বিশ্বাসের পরিবারের থেকে। এ বাড়িতেই তাঁদের পূর্বপুরুষের বাস ছিল। সে বাড়ি কেনবার পর ১৯২৫ সাল থেকে দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজোর স্থায়ী ঠিকানা হয় এই বাড়িটি। সাধারণত বলা হয় শিবের উপাসক বলেই এ বাড়ির ঠাকুর বিরাজ করেন হরগৌরি রূপে। তাই দেবীও পূজিত হন এখানে ঘরের মেয়ের মতোন।
প্রতিপদে বোধনের মাধ্যমে আরাধনা শুরু হয় মেয়ের। তারপর প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা জামাই আদর করে সাদা ময়দার লুচি, মিষ্টি সহ বিভিন্ন ভোগের আয়োজন করা হয়। তবে বাকি সমস্ত অব্রাহ্মণ বাড়ির মতো এখানেও অন্নভোগ হয় না। এ বাড়িতে পশুবলি এবং ফলবলির কোনোটিরই চল নেই। পুজোর বিশেষ প্রথা বলতে গেলে কুমারী পুজোর এক আশ্চর্য বিশেষত্ব আছে। প্রতিবার যে নাবালিকা মেয়েটিকে কুমারী হিসেবে স্থির করা হয়, তার পুজো করেন আর কেউ না বাড়ির বৌ-রাই। সমস্ত পুরুষতান্ত্রিক বেড়াজালের উর্ধ্বে গিয়ে এই রীতি যেন দেবীশক্তিরই এক ভিন্ন আরাধনার ইঙ্গিত দিয়ে যায় আজও।
দশমীর দিন সকালে অপরাজিতা পুজোর মধ্যে দিয়ে বিসর্জনের রেশ ছড়িয়ে পড়লেও, সূর্যাস্তের আগে বিসর্জন দেওয়া হয় না এ বাড়ির হরগৌরীকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, এ বাড়িতে প্রতি বছর কালীপুজোর দিনে এক বিশেষ ফানুস উৎসবের আয়োজন করা হয়, যার মূল সৃষ্টিতে এবং উদ্যোগে থাকেন এ বাড়িরই প্রবীণ সদস্য শ্রী অজয় দত্ত। তাঁর সৃষ্টি করা এই ফানুসের ঐতিহ্য আজও কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে, হাতে বানানো ফানুসের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে চলেছে বহু বছর ধরে। ফলে দুর্গাপুজোর পাশাপাশি এ বাড়ির ফানুস উৎসবেও চাইলে সামিল হতে পারেন।
বাড়ির ঠিকানা – ৩৩/২, বিডন স্ট্রিট, কলকাতা-৬