ভূত মানেই অদ্ভুত। ভূত শব্দটার মধ্যে রয়েছে অজানা রহস্য। গা ছম ছম করা ভাব। অদৃশ্য, অলৌকিক, কাল্পনিক অবয়বটি কি আসলেই আছে! অনেকেই মনে করেন ভগবান আছে মানে ভূতের অস্তিত্বও সম্ভব। তবে একটু গভীরভাবে ভাবলে হয়তো মনে হবে এর কোনো অস্তিত্বই নেই। কিন্তু এসব প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটিজ খুলে দিচ্ছে অজানা রহস্যের দরজা। ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন বহু পুরোনো বাড়িতে রাত নামলে সত্যিই নেমে আসে অদ্ভুত নীরবতা। তেমনই কলকাতার পৌরাণিক ইতিহাসে বহু প্যারানরমাল ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়।
কলকাতার ঐতিহ্যবাহী একাধিক বড় বড় বাড়িতে এখনো যাঁরা রাতে পাহারায় থাকেন, তাঁরা ওই সব চিহ্নিত জায়গার নাম শুনলেই রীতিমতো ঈশ্বরের নাম জপতে শুরু করেন। কলকাতার এই ১০টি ভুতুড়ে জায়গার হদিশ জেনে নিন:-
১) নিমতলা শ্মশানঃ মধ্য কলকাতার সবথেকে পুরনো এই ঘাটে বহু শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। এত মানুষের শবদাহ হয়েছে যেখানে সেখানে অশরীরি আত্মার বিচরণ অতি স্বাভাবিক। অমাবস্যা রাত্রে নানাবিধ অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন অনেকেই, এমনটাই জনশ্রুতি। শোনা যায়, অঘোরী তান্ত্রিকেরা নাকি বিশেষ বিশেষ রাতে এই শ্মশানে আসেন। মৃতদেহের উপর বসে রক্তপান করেন।
২) হাওড়া ব্রিজের নীচের ঘাটঃ মল্লিক ঘাট ফুল বাজারের নিকটবর্তী ঘাটটিতে যাঁরা নিয়মিত যাতায়াত করেন তাঁদের অনেকেই বলেন, এই ঘাটে নাকি প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু ভৌতিক ঘটনা ঘটে। রোজই প্রায় অনেক মৃত্যু দেখে এই ঘাট। কোনও মহিলাকে সাদা শাড়ি পরে ঘুরতে দেখেছেন কিংবা মহিলার গলায় নাকি সুরে কান্না শুনেছেন— এমন দাবি স্থানীয়দের মধ্যে অনেকেই করে থাকেন। অনেকেই নাকি দেখেছেন, ভোররাতে নাকি এই ঘাটের ধারে জলের নিচ থেকে দুই হাত বাড়িয়ে কাউকে ডাকতে দেখা গিয়েছে। তাদের ধারনা যারা এখানে মারা গেছেন তাদের আত্মাই ঘুরে বেড়ায়।
৩) ন্যাশনাল লাইব্রেরিঃ কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিকে ঘিরে নানা ধরনের গল্প শোনা যায়। এই প্রাচীন লাইব্রেরিটির দুর্নাম রয়েছে ভুতুড়ে কার্যকলাপের জন্য। যাঁরা এখানে পড়াশোনা করতে যান তাঁদের অনেকেই বলেছেন, পড়াশোনা করতে করতে আচমকা ঘাড়ে অদৃশ্য কারোর নিঃশ্বাস অনুভব করেছেন। ন্যাশনাল লাইব্রেরির বল ডান্সের ফ্লোর থেকে ভেসে আসে কনসার্টের সুর। স্তব্ধ দুপুরে শুনেছেন অশরীরি কারোর পদচারণার শব্দ। লাইব্রেরী কর্মচারীদের মতে, লর্ড মেটকাফের স্ত্রীর আত্মাই নাকি এখনও ঘুরঘুর করে লাইব্রেরির অন্দরে বাহিরে।
৪) পুতুলবাড়িঃ কলকাতা শহরের আহিরিটোলার বাড়ি নিয়ে রহস্য আজও সবার মুখে মুখে। বাংলা সাহিত্যে পুতুলের বাড়িটি নিয়ে সত্যজিৎ রায় ও লীলা মজুমদারের কিছু ভয়ঙ্কর গল্প রয়েছে। এটা কলকাতা শহরের সবচেয়ে রহস্যজনক স্থান। অনেকে এখনও এই বাড়িতে থাকলেও সন্ধ্যার পর নাকি দোতলা বা তিনতলায় ওঠার সাহস পান না। পুতুলরূপী মহিলা অতৃপ্ত আত্মা নাকি ঘুরে বেড়ায় এ বাড়ির আনাচে-কানাচে। গভীর রাতে তো বটেই এমনকি ভরদুপুরেও কিছু অশরীরীর উপদ্রব রয়েছে এখানে। এর নেপথ্যে আসলে কি!
এক সময় বাড়িটিতে এক বড়লোক মনিব বাস করতেন। বাড়ি দেখাশোনায় কয়েকজন দাসীও কাজ করত। মনিব দাসীদের সঙ্গে জোরপূর্বক যৌনসম্পর্ক করতেন। কিছু দাসী মনিবের এ অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় তাদের হত্যা করা হয়। হত্যার পর বাড়ির পেছনে তাদের লাশ মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল। এরপর কতকাল পার হলো কিন্তু আজ অবধি মাঝে মাঝে রাতে মেয়েলি কণ্ঠের অশরীরীদের কান্নার শব্দ শোনা যায়। স্থানীয়দের ধারণা মনিবের এ পাপের কারণে এখনো পুতুলবাড়ীতে অশরীরী আত্মার আনাগোনা।
৫) রবীন্দ্র সরোবর মেট্রোস্টেশনঃ দিনে মেট্রোর লাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। আর সেইসব আত্মহত্যার ৮০ শতাংশই নাকি কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনে ঘটেছে। রাত্রে এই স্টেশন থেকে শেষতম মেট্রোতে চড়েছেন যাঁরা তাঁরা অনেকেই দাবি করেন, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার সময়ে প্রায়-নির্জন স্টেশনে তাঁরা বিভিন্ন ছায়ামূর্তিকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। তাই গা ছমছমে স্থানগুলির মধ্যে এটিও অন্যতম।
৬) হেস্টিংস হাউসঃ আলিপুরের হেস্টিংস হাউস শহরের এক অন্যতম পুরনো স্থাপত্য। ওয়ারেন হেস্টিংসের বানানো এই বাড়ি একদা ছিল গভর্নরের বাসস্থান। এখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা কলেজ রয়েছে এই বিল্ডিংয়ে। ছাত্রীরা বলেন, নানা ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা দেখা যায় বিল্ডিংয়ে। অনেকেই বলেন, এক ব্রিটিশ ব্যক্তি ও এক কমবয়সী ছেলেকে এখানে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তাদের ধাওয়া করলেই নাকি একদম গায়েব হয়ে গিয়েছে। আবার এ জায়গা সম্পর্কে শোনা যায়, অশরীরী আত্মারা সবচেয়ে বেশি এখানেই ঘোরাঘুরি করে।
৭)সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রিঃ নিমতলা, ক্যাওড়াতলা শ্মশান ঘাট খানিকটা আলোময় দেখালেও শহরের প্রাচীন সিমেট্রি ও কবরখানাগুলো কিন্তু এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন। সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি তেমনি একটি গোরস্থান। প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৭৬৭ সালে। আবছা অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল আর ঘন গাছপালায় ঘেরা গোরস্থানে গেলেই গা ছম ছম করে ওঠে। এখানে ব্রিটিশ সৈনিকের কবর সবচেয়ে বেশি। বলা চলে সাহেবি গোরস্থান। শোনা যায়, রাত হলেই নাকি কফিন থেকে জেগে ওঠে শত বছরের পুরনো আত্মা।
একবার তো ঘটেই গেল বিপত্তি। সন্দীপ রায়ের ফেলুদা সিরিজের ‘গোরস্থানে সাবধান’-ছবির শুটিংয়ের উদ্দেশ্যে একবার সিমেট্রির দরজা খোলা হয়েছিল। ব্যাস উলটপালট করে দিল শুটিং সেটে থাকা সবার মন। অদ্ভুত সব শব্দ আর ছায়ায় ভয়ে শিহরিত হয়ে উঠল সবাই। এরপর থেকে আজ অবধি কেউ সেখানে ভুলেও পা বাড়ায়নি। এরকম আরও একটি সেমিট্রি রয়েছে লোয়ার সারকুলার রোডে। ঠিক আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোডের ওপরে। পর্যটকরা ঘুরতে আসেন ঠিকই কিন্তু রাত হলে ঢোকার সাহস হয় না কারও। এক পর্যটক ছবি তুলতে গিয়ে সাদা পোশাকের আবছা মহিলাকে দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পার্ক সার্কাসের বিশাল কবরখানার মতো স্থান, এ শহরে খুব কম রয়েছে। পার্কস্ট্রিটের আশপাশেরর স্থানীরা খুব সকালে এবং সন্ধার পর তাদের জানালা বন্ধ করে রাখেন।
৮) রাইটার্স বিল্ডিংঃ বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য প্রশাসনিক দপ্তর হিসেবে নবান্ন ব্যবহৃত হলেও দীর্ঘদিন ধরে রাইটার্স বিল্ডিং ছিল রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয়। কলকাতার অন্যতম এই রাইটার্স বিল্ডিংয়ে রাত নামলে জনশূন্য অলিন্দ যেন হয়ে ওঠে অশরীরীদের আখড়া। একথা স্বীকার করে নেন এখানে রাত কাটানো প্রতিটি নৈশপ্রহরী। জানা যায়, এই রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পাঁচ নম্বর ব্লকটি মোটেই সুবিধার স্থান নয়। রাত নামতেই এখানকার বারান্দা দিয়ে কারা যেন হেঁটে বেড়ায়। দৌড়ে গিয়েও দেখা যায় না কাউকেই। এখানকার ঘরগুলো থেকে শোনা যায় একটানা টাইপের আওয়াজ। দোতলায় কারা যেন ভেসে উঠে মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়।
ইতিহাস বলছে, এখানেই একসময় ছিল কলাগাছের জঙ্গল। একবার বেশ কয়েকজন ইংরেজকে এখানেই কবর দেওয়া হয়েছিল বলেও জানা যায়। লর্ড ভ্যালেনটিনের তথ্য মতে, ঘোড়ায় টানা গাড়ির খেলা বা ডুয়েল (বন্দুকযুদ্ধ) চলত এই এলাকায়। লেগে থাকত খুন-জখম। এমন বহু ঘটনার কথা আজও এই এলাকায় মুখে মুখে ফেরে। এখানে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনয়-বাদল-দীনেশের হাতে কর্নেল সিমসনের খুন হওয়ার ঘটনাও ফেলে দেওয়া যায় না। সব মিলিয়ে খোদ এই সরকারি দপ্তরটিতে অশরীরীদের অস্তিত্ব আজও অস্বীকার করতে পারেন না কেউই।
৯) রয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাবঃ ঘোড় প্রতিযোগিতায় মুখরিত থাকে ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব খ্যাত রেসকোর্স ময়দানটি। রাতে এখানে ঘটে যায় অলৌকিক সব ঘটনা। কে বা কারা যেন ঘোড়া নিয়ে ছুটে বেড়ান এখানে। স্পষ্ট দেখতে পাওয়া ঘোড়া নিমিষেই বাতাসে মিলিয়ে যায়। এর সঠিক মতাদর্শ না পেলেও ইতিহাসে রয়েছে একটি কাহিনী। রয়্যাল পরিবারের ব্রিটিশরা এখানে ঘোড় সওয়ার করতেন। একবার এক ব্রিটিশ জর্জ উইলিয়ামস তার বিখ্যাত সাদা ঘোড়া নিয়ে ময়দান চষিয়ে বেড়াতেন। অপরূপ সাদা ঘোড়াটির নাম ছিল পার্ল হোয়াইট। প্রচুর রেস আর ট্রফি জেতায়, পার্ল হোয়াইটকে তখনকার সময় এক নামেই চিনত। উইলিয়ামস ঘোড়াটিকে নিজের প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসতেন।
কিন্তু একবার অ্যানুয়াল টার্ফি টুর্নামেন্টের আগে আকস্মিকভাবেই পার্ল হোয়াইট অসুস্থ হয়ে পড়ে। উইলিয়ামস প্রাইডের প্রচুর যত্নআত্তি করেও লাভ হয়নি। যার ফলাফল অ্যানুয়াল ট্রফি হেরে যান। এরপরই একদিন সকালে জর্জ দেখে, খোলা ট্রাকের ওপরে মরে পড়ে আছে তার প্রিয় সাদা ঘোড়াটি। পার্ল হোয়াইটের শোক আর মায়ায় জর্জও বেশিদিন পৃথিবীতে ছিলেন না। শোনা যায়, প্রতি শনিবার রাতে পূর্ণিমার আলোয় নাকি ঘোড়া ও তার মালিকের আবছা মূর্তি এখানে দেখা যায়।
১০) আকাশবাণীঃ কলকাতার পুরনো ভুতুড়ে বাড়ির মধ্যে এক নম্বর গারস্টিন প্লেস এবং দ্বিতীয় এর প্রথম অফিস। আকাশবাণীর পুরনো দফতর গারস্টিন প্লেসে বারবার দেখা গিয়েছে অশরীরী আত্মা। ফাঁকা লম্বা করিডর, অজস্র স্টুডিও আর ব্রিটিশ অবকাঠামো মিলিয়ে আকাশবাণীর ভুতুড়ে অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। রাত গভীর হলে অনেকেই দেখেছেন সাহেবের ছায়া উবু হয়ে কাজ করছে। আবার কেউ কেউ দেখেন মধ্যরাতে রেকর্ডিং রুমের বারান্দায় কে যেন গান শুনছেন। হয়তো বেতারের আশ্চর্য বিজ্ঞানী সে যুগের মনে জন্ম দিয়েছিল এসব ভুতুড়ে বিশ্বাসের। এখনো নানা স্টুডিও থেকেই রাতে ভেসে আসে যান্ত্রিক সুর। বলাই বাহুল্য, সেই যন্ত্রগুলো কোনো মানুষ বাজায় না।