সুজয় নবীন ঃ কেন্দ্র সরকার জানাচ্ছে নেতাজি সংক্রান্ত সমস্ত ফাইল তারা প্রকাশ করে দিয়েছে। তাদের কথামতো ৮৭ টি ফাইল পড়ে রয়েছে PMO তে যা প্রকাশ পেলে ভারতের সাথে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। তবে এই যুক্তি একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ জার্মানির সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবার সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু এখন সেই জার্মানিকে সবাই মান্যতা দিচ্ছে। আবার জাপান কি হিরোশিমা নাগাসাকি বোমা বিস্ফোরণের পর আমেরিকার উপর রাগ করে বসে আছে? তাই এই যুক্তি অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু এটা একটা দিক; আরেকটি দিক হচ্ছে কংগ্রেস যখন বুঝতে পেরেছিল আমরা চিরকাল ক্ষমতায় থাকবো না এবং অন্যান্য দল একদিন ক্ষমতায় আসবেই। তাই তারা ফাইল ম্যানুপুলেট করেছিল। সেই পুরনো ফাইল গুলির মধ্যে নেতাজি’র ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে এমন কিছু ঘটনা বা গল্প তৈরি করে নথির সাথে যুক্ত করা হয়েছে যে সেগুলি প্রকাশ্যে এলে আমাদের হয়ত নেহেরু-গান্ধীর থেকেও নেতাজিকে অসৎ চরিত্রের মানুষ বলে মনে হতে পারে। এগুলি ইচ্ছে করে পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত করা হয়েছে। সুতরাং এই জন্যই সরকারী স্তরে আনঅফিসিয়ালি অফ দা রেকর্ড তাঁরা নেতাজি গবেষকদের জানিয়েছেন কংগ্রেসের এই কারসাজির কথা। যার জন্য এই ফাইলগুলি তারা ক্লাসিফাইড করতে পারছেন না।
![নেতাজির সাবমেরিনের কিছু দুস্প্রাপ্য ছবি](https://i0.wp.com/theindianchronicles.com/wp-content/uploads/2022/05/283201370_4958308824281975_8411676891629118978_n-300x210.jpg?resize=387%2C271&ssl=1)
আরেকটি বিষয় হল কেন্দ্র সরকারের কাছে ভগবানজী সংক্রান্ত পৃথক ফাইল আছে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ইন্টেলিজেন্ট বিউরো, সিবিআই, উত্তরপ্রদেশের স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বহু ফাইল আছে। কিন্তু ভগবানজী যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন বিষয়টি অফিসিয়ালি স্বীকৃত নয়। তাই টেকনিক্যালি ওই কারণ দেখিয়ে সরকার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারছে। সাধারণ মানুষের উচিত ভগবানজী সংক্রান্ত ফাইল ক্লাসিফাইড করার দাবি তোলা। গণজাগরণের ফলে যখনই বিষয়টি ভোটের দিকে যাবে তখন সরকার নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হবে। যেমন লক্ষ্য করে দেখবেন কুণাল ঘোষ লিখছে উনার মৃত্যু সংক্রান্ত কোনো প্রামাণ্য রিপোর্ট নেই, কেন সরকার তাঁর সমস্ত ফাইল প্রকাশ করছে না। এইরকম দাবি তুলছে কারণ এগুলি এখন ভোটের ইস্যু হয়ে গিয়েছে। এ প্রসঙ্গে কথা বললে এখন কিছু ভোট বার্তি পাওয়া যাবে, নেতাজি অনুরাগীরা খুশি হবেন। তাই ভগবানজী সংক্রান্ত বিষয় যদি ভেসে ওঠে এবং তাঁর সংক্রান্ত সমস্ত ফাইল যদি প্রকাশ করার দাবি তোলা হয় তাহলে আরও বহু কিছু জানা যাবে। যেমন- এলাহাবাদ কোর্ট বলেছিল ভগবানজী কে ছিলেন তা সরকারের জানা উচিৎ। জাস্টিস মুখার্জি নিজে অফ দা রেকর্ড জানিয়েছিলেন, “I am 100% sure that, he (Bhagwan Ji) was Netaji.” কিন্তু আমাদের কাছে ক্লিঞ্চিং এভিডেন্স নেই। তাই সেই সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিৎ। ভগবানজীর আইডেন্টিটি কি? কী তাঁর পরিচয়? তিনি কোথা থেকে এলেন? প্রভৃতি প্রশ্ন তোলা উচিৎ, তাহলে সরকার চাপে পরতে পারে।
![](https://i0.wp.com/theindianchronicles.com/wp-content/uploads/2022/05/NetajiBose-300x178.jpg?resize=511%2C303&ssl=1)
এবার আমি তোমার প্রশ্নের মূল প্রসঙ্গে আসি, ক্ষমতায় যেই সরকারই থাকুক না কেন তাদের নিজেদের মধ্যে এক বোঝাপড়া থাকে। যে তুমি আমার শত্রু বা প্রতিপক্ষ ঠিকই কিন্তু তুমি এই সীমা পর্যন্ত আমার বিরোধ করো কিন্তু বাড়াবাড়ি করলে তোমার কিছু রেকর্ডস আছে আমাদের কাছে সেগুলো আমরা প্রকাশ করে দেব। তুমিও জানো বেশি কিছু বললে এমন কিছু তথ্য আমার সম্বন্ধে বেরিয়ে আসবে যা প্রীতিকর হবে না। ঠিক এভাবেই নিজেদের মধ্যে একপ্রকার আঁতাত তৈরি হয়ে যায়। যেমন লক্ষ্য করলে দেখবেন সোনিয়া গান্ধী বিশ্বের ধনীতম মহিলাদের মধ্যে ষষ্ঠতম। কিন্তু তা কী করে সম্ভব হল? কোন ফাউন্ডেশন বা কোথা থেকে তিনি এত টাকার মালিক হলেন? ডক্টর সুব্রমানিয়াম স্বামী সহ বেশ কিছু ব্যক্তি তথ্যসহকারে বলেছেন তিনি রাশিয়ার গুপ্তচর বিভাগের সাথে কখনো জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু এই সকল তদন্ত বেশি দূর এগোয় না। মাঝে মাঝে খবরগুলি শুধু শিরোনামে আসে। তবু বলব এই সরকারের আন্ডারে গবেষকরা স্বাধীনভাবে বই প্রকাশ করতে পারছেন, সিনেমা নির্মাণ করতে পারছেন। এছাড়াও প্রশাসনিকভাবে সরকার নেতাজিকে সম্মান দেখাচ্ছেন। ইন্ডিয়া গেটে নেতাজির মূর্তি নির্মাণ সহ INA ভেটারেন্সদের সম্মানিত করা, রেড ফোর্টে নেতাজি মিউজিয়াম তৈরি হয়েছে এই সরকারের সময়কালে। অন্তত এই সরকার এই পদক্ষেপ গুলো নিয়েছে এবং এখন নেতাজিকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করার দাবিও উঠেছে। নেতাজির ছবি কারেন্সিতে রাখার দাবি উঠছে। এই ডিম্যান্ডগুলো বাড়তে দেওয়া হচ্ছে বলে জানবে। মিডিয়াও এই প্রসঙ্গে এখন বেশ তৎপর থাকছে। কারণ তারাও জানে নেতাজী সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে মানুষজনের আগ্রহ আছে।
![](https://i0.wp.com/theindianchronicles.com/wp-content/uploads/2022/05/283797855_4958309070948617_2195764277665558719_n-300x228.jpg?resize=401%2C305&ssl=1)
তবে খেয়াল রাখবে নেতাজীকে নিয়ে বিজেপি – RSS খুব একটা স্বচ্ছন্দে নেই। তার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে ১৯৪৫ পর্যন্ত নেতাজির রাজনৈতিক ভাবধারার সাথে RSS বা হিন্দু মহাসভার খুব একটা সাযুজ্য নেই। বরং তর্ক বিতর্ক হত। কলকাতায় বিভিন্ন সভাতে নেতাজির সাথে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর খোলামেলা বাকবিতণ্ডা হত। RSS বা হিন্দু মহাসভার মূল দাবী ছিল হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করে ভারত স্বাধীন হবে অন্যদিকে মুসলিম লীগও পৃথক রাষ্ট্র চেয়েছিল। সেই সময় হিন্দু মহাসভা থেকে রাবণের একটা কার্টুন ছবি আঁকা হয়েছিল। সেই ১০ মাথাওয়ালা রাবণের দশটি মাথার মধ্যে একটি মাথা ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর। সুতরাং হিন্দু মহাসভার সাথে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক সহাবস্থানে মিল কতটা এখান থেকেই অনুমান করা যায়। কিন্তু এর সাথে এটাও ঠিক যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনিও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, বীর সাভারকারের সাথে সুভাষচন্দ্র বসুর আলাপ-আলোচনা হয়েছিল এবং তিনিই প্রথম সুভাষচন্দ্র বসুকে রাসবিহারী বসুর সাথে সাক্ষাৎ করার কথা বলেন। ও দেশের বাইরে থেকে আর্মি গঠনের কথা বলেন।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো – ভারতীয় সৈন্যদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা নিয়ে নেতাজির প্রবল আপত্তি ছিল। তিনি গান্ধীজিকে বলেছিলেন আপনি একাধারে অহিংসার কথা বলেন অন্যদিকে দেড় লক্ষ সৈন্যদের ইংরেজদের হয়ে লড়াই করার কথা বলছেন? কেন তারা ভারতের জন্য লড়াই করবে না, কেন ব্রিটিশদের হয়ে লড়াই করবে? যদি আজ তারা ব্রিটিশদের হয়ে অস্ত্র না ধরে তাহলে ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবে – এটি ছিল নেতাজির যুক্তি। এই প্রসঙ্গে সাভারকার সুভাষচন্দ্র বসুকে বলেছিলেন, আমাদের হাতে অস্ত্র নেই। কিছু বোমা বেঁধে বা পিস্তল চুরি করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কতটা সম্ভব? কিন্তু হাজার হাজার সৈন্যদের হাতে অস্ত্র যদি চলে আসে এবং তুমি যদি বাইরে থেকে সেনা নিয়ে আসতে পারো তাহলে অল্প কিছুটা সময়ের মধ্যেই এই সৈন্যরাই বন্ধুকের নলটি ঘুরিয়ে দেবে ইংরেজদের দিকে। আর হয়েও ছিল তাই। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে বহুলোক ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’তে (INA) চলে এসেছিল। সুতরাং রাজনৈতিক অবস্থান এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের শ্রদ্ধার জায়গা কিন্তু আলাদা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে কথা বলি, ১৯৬০ – ৭০’এর দশকে যে ভগবানজীকে আমরা পাচ্ছি তাঁর সম্বন্ধে আমেরিকার রিপোর্ট বলছে – তিনি এখন নেহেরু বিরোধী হিন্দু সংগঠন গুলিকে শক্তিশালী করছেন। এই প্রসঙ্গে ভগবানজীকে এক অনুরাগী ভক্ত প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো ১৯৪৫’এর আগে অন্য কথা বলতেন! প্রত্যুত্তরে গর্জে উঠেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘তখনকার বাস্তবতা এবং এখনকার বাস্তবতা দেখো।’ কৌশল জানবে দীপায়ণ পাল্টাতে হয়। আমি ১৮ বছর বয়সে যে কথা বলেছি তা ৮০ বছর বয়সেও কি বলে যাবো? নিজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কি আমি নিজেকে পাল্টাবো না? কিছু জানব বা শিখব না? পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে অথচ আমাদের ধ্যান-ধারণা কি পাল্টাবে না। তিনি বললেন, ভারত বিভাজনের সময় পাকিস্তানে যে সাংঘাতিক অত্যাচার-ধর্ষণ হয়েছে তার মূল্য দিতে হবে না? তুমি শীতকালে যে জামা কাপড় পরো গরমকালেও কী সেই একই জামা কাপড় পরো?
সুতরাং এটা আমাদের মনে রাখতে হবে- বিজেপি, RSS সহ তথাকথিত কট্টর হিন্দু সংগঠনগুলির সাথে নেতাজীর জড়িয়ে থাকা ইতিহাস খুব একটা স্বস্তির নয়। তাই তাঁরাও বেশি বলতে পারেন না বা বেশি দূর এগোতে পারেন না। ব্যক্তিগতভাবে যে যতই শ্রদ্ধা – ভক্তি করে থাকুক না কেন কোথাও একটা বিরাট পার্থক্য ছিল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু চেয়েছিলেন, পূর্ণ স্বরাজ, পূর্ণ স্বাধীনতা, অখণ্ড ভারত স্বাধীন হবে। তৎকালীন ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলতে পারেনি। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় গোলওয়ালকার স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, RSS এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবে না। যদি কেউ অংশগ্রহণ করতে চাই ব্যক্তিগতভাবে করতে পারে। কিন্তু RSS’এর ব্যানারে নয়। এই কথাগুলি নিয়ে হিন্দু গোষ্ঠী বা সংগঠন গুলোর মধ্যে একটু অস্বস্তি রয়েছে। তাই সম্পূর্ণ খোলাখুলিভাবে কোন পার্টি আজও নেতাজিকে সমর্থন করতে পারে না।