Home » সিঙ্গারা আবিস্কারের ইতিহাস

সিঙ্গারা আবিস্কারের ইতিহাস

সুস্বাদু তেলেভাজা সিঙ্গারা তিনকোনা হওয়ার পেছনে, কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার যে কথিত অতীত ইতিহাস এখনও বর্তমান, আসুন তা জেনে নেওয়া যাক। ১৭৬৬ সাল, তখন কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেই রাজ পরিবারের রাজাভিষেক। তিনি ভালোবাসতেন গরম গরম লুচি খেতে। কিন্তু সেই গরম লুচি রাজ দরবারে রাজার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতেই ঠান্ডা হয়ে যেত, যে কারণে সেই সময় রাজবাড়ির হালুইকর অনুমতি চেয়েছিলেন রাজার কাছে রাজসভায় মিষ্টান্ন পাঠাতে। কিন্তু রাজার মধুমেহ রোগ থাকায় রাজ চিকিৎসকের পরামর্শে রাজা সেই হালুইকর্কে শুলে চড়ানোর হুকুম দিয়েছিলেন। তখন হালুইকর অনেক অনুনয় বিনয় করে রাজার কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন এবং রাজা আদেশ দিয়েছিলেন সে যেন তিন রাতের মধ্যে দেশ ত্যাগ করেন।

কিন্তু প্রথম রাত পেরিয়ে যাবার পরে দ্বিতীয় রাত্রে হালুইকরের স্ত্রী ঠিক করলেন দেশ ত্যাগের আগে একবার দেখা করবে রাজার সাথে। সেইমতো হালুইকরের স্ত্রী তৃতীয় দিন সকালবেলা রাজ দরবারে এসে প্রণাম জানায় স্বয়ং রাজা মশাইকে। রাজসভায় আসার কারণ তাকে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে সে রাজাকে জানায়, সে নাকি এমন ভাবে লুচি তরকারি করতে পারে, যা রাজা আধঘন্টা বাদে খেলেও গরম পাবেন। এবং এরকম লুচি তরকারি নাকি আধঘন্টা বাদে খাওয়াই ভালো। এবার রাজা কিঞ্চিত কিঞ্চিৎ কৌতূহলী হয়ে হালুইকরের স্ত্রীকে পাঠালেন পাকসালে এবং এবং আদেশ দিলেন যখন রাজসভা থেকে খবর পৌঁছবে তৎক্ষণাৎ পাকশাল থেকে খাবার পৌঁছানো চাই রাজসভায়। হালুইকরের স্ত্রী মৃদু হেসে রাজাকে জানালেন, খাবার তখনি পৌঁছাবে কিন্তু তিনি যেন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খান,কেননা তাতে মহারাজার জিভ পুড়ে যেতে পারে। এই বলে বিস্মিত মহারাজের সামনে দিয়ে হালকা হেসে হালুইকরের স্ত্রী চলে গেল পাকসালে। হুকুম এলেই লুচি ভাজতে হবে, রাজ-পাচক আলুর তরকারি তৈরি করে পালসালে দাঁড়িয়ে কাপছেন। ময়দার তালমাখা পড়ে রয়েছে হাতের সামনে, সেই দেখে হালুইকরের স্ত্রী পাচককে কটাক্ষ করে বসল ময়দার তালমাখা নিয়ে। লিচি কেটে, লুচি বলে, কাঁচা ময়দার ভেতর লুচির জন্য তৈরি সাধারণ তরকারি ভরে দিয়ে সমভূজাকৃতি ত্রিভুজের গড়ন বানিয়ে আড়ষ্ট রাজ পাচকের সামনে নিজের আঁচল সামলে শুরু করলো তুমুল গল্পঃ।

এরপর রাজার আদেশ আসতেই ফুটন্ত ঘি ভর্তি করায়, তরকারির পুর ভরানো দশটি ত্রিভুজাকৃতির লুচির ময়দা ফেলে দিলো এবং নিমেষের মধ্যে সেই সোনালী রঙের ত্রিভূজ গুলি সর্নথালাই তুলে সাজিয়ে নিয়ে নিজেই চললো রাজসভায়।

এরপর হালুইকরের স্ত্রী মহারাজার সামনে খাবার রেখে মহারাজা কে জানালেন, খাবারটির নাম সমভূজা। মহারাজ যেন খাবারটি পুরো মুখে না ঢুকিয়ে একটি কামড় দিয়ে দেখেন খাবারটি ঠান্ডা না গরম এবং তার স্বাদ তাকে জানান। উত্তরে কিছু জানাননি ঠিকই তবে প্রায় ৬ মাস পরে হেসে উঠেছিলেন মহারাজা, শান্তি পেয়েছিলেন তামাম প্রজাকুল। তিনি তিন ছড়া মুক্তমালা খুলে হালুইকরের স্ত্রীর হাতে দিয়েছিলেন এবং রাজবাড়ীর হালুইকরের দন্ডজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

১৭৬৬ সালে এই সুস্বাদু তেলেভাজা সিঙ্গারা, কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার রাজ হালুইকর, কলিঙ্গ তথা বর্তমান ওড়িষ্যা থেকে আগত গুনিনাথ হলুইকরের ষষ্ঠ পুত্র গীরিধারী হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী দেবী আবিষ্কার করেছিলেন। পরবর্তীকালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রামপ্রসাদ, নিজেই সন্ধ্যা আরতি সেরে প্রতি সন্ধ্যায় বসতেন এক থালা সিঙ্গারা নিয়ে। দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দরবার থেকে বাইশটি সুসজ্জিত হস্তি ভেট নিয়ে গিয়েছিল উমি চাঁদের কাছে – ২২ টি স্বর্ণ থানায় ভরানো ২২০০টি সিঙ্গারা। এই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রেরই সৌজন্যে, ভারতীয় খাদ্য হিসেবে সিঙ্গারার সাথে রবার্ট ক্লাইভ এর প্রথম পরিচয়। সিঙ্গারার জন্য ইতিহাস স্বীকৃতি দিয়েছে এই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কে তবে ভুলে গেছে তার প্রধান হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী বেহারার।

ঐতিহাসিকদের মতে নবম শতাব্দীতে পারস্যের অধিবাসীরা যব এবং ময়দার তালের সঙ্গে গাজর করাইসুটি রসুন ও মাংস মেখে সেকে খেত, যাকে বর্তমান সিঙ্গারার জনক হিসেবে ধরা হলেও, সুদূর পারস্য থেকে ভারতবর্ষে এসেও তারা ময়দার তালে মাংসের কুচি ঢুকিয়ে সেকেই খেতেন। এবং এরও বহু পরে তারা ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব উপকূলে বিভিন্ন মসলার সহযোগে তৈরি আলুর তরকারি, ময়দার ভেতর ঢুকে গিয়ে ভাজার পদ্ধতিতে চমৎকৃত হন। ধরিত্রী দেবী সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন এই অসাধারণ খাবারটির, যেটি সেই ১৭৬৬ সাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা তথা সারা ভারতজুড়ে সিঙ্গারা, সামোসা এবং আরো ও ভিন্ন ভিন্ন নামে। ইংরেজিতে যাকে বলে, কমনসেন্স মেকস আ ম্যান আনকমন।

ডায়াবেটিক পেশেন্টদের কিছুক্ষণ বাদে বাদে খিদে পাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু আজ চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত। ডাক্তারবাবুরা বলেছেন অনেকক্ষণ বাদে একসাথে প্রচুর পরিমাণে না খেয়ে ক্যালরি মেপে কিছুক্ষণ বাদে বাদে অল্পস্বল্প করে খাবার খেতে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো সেই যুগে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে ডাক্তার বাবুদের হৃদয় ছিল বিশাল। মধুমেহ রোগীরা তখন তেল ঘি মসলা, ভাজা খেলেও তারা রাগ করতেন না। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, আজকের যুগের ডাক্তারবাবুরা আত কে উঠবেন যদি দেখেন কোন ডায়াবেটিক পেশেন্ট প্রতি ঘন্টায় সিঙ্গারা খাচ্ছেন। তবু আটকানো যায়নি গীরিধারি হালুইকরে স্ত্রী ধরিত্রী দেবীর আবিষ্কার এই সিঙ্গারাকে। শহরে অভিজাত পরিবারের তাসের আড্ডা তেই হোক কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামের নড়বড়ে জরাজীর্ণ চায়ের দোকানের সেকেলে অ্যাডাতেই হোক – বিকেল সাড়ে চারটেই হোক বা সকাল পৌনে দশটা, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রধান হালুইকারের স্ত্রীর আবিষ্কারটি সর্বদা সর্বত্রগামি। সেই সময় রাজসভায় রাজ দরবারে যা পরিবেশিত হয় তার প্রশংসা প্রশংসিত হবে এইতো স্বাভাবিক।

ভাষাবিদদের মতে, সমভূজা–> সম্ভোজা–> saamvoosa–> সামোসা। মতান্তরে, সমভুজা–> সম্ভোজা–> সিভুসা–> সিঙ্গুরা (নদীয়ার কথ্যভাষার প্রভাবে)–> সিঙ্গারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Click to Go Up
error: Content is protected !!