Home » সত্যজিৎ-সুভাষ সখ্য

সত্যজিৎ-সুভাষ সখ্য

সেটা ১৯৬১ সাল। সারা বাংলা জুড়ে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উপলক্ষে গান, কবিতা,
চলচ্চিত্র, নাটক, ইত্যাদি শিল্পকলার বিভিন্ন দিকে নানা ধরণের সৃষ্টি হয়ে চলেছে।
তারই সঙ্গে বাংলা শিশু ও কিশোরসাহিত্যে এক নতুন পর্ব শুরু হল – সত্যজিৎ রায়
ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমারের ঐতিহ্যবাহী ‘সন্দেশ’
পত্রিকার পুনঃপ্রকাশ। কিন্তু এই দুই ভিন্ন জগতের দুজন মানুষ কিভাবে কাছাকাছি
এলেন? সত্যজিৎ-সুভাষ সখ্যতার গোড়ার দিকের কথা জানতে হলে আমাদের ৪০-র
দশকে ফিরে যেতে হবে। এক সাক্ষাৎকারে সুভাষ জানিয়েছেন “যতদূর মনে পড়ে
সত্যজিতের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বিষ্ণু দে-র বাড়িতে। বিষ্ণু দে-র ওয়েস্টার্ন
ক্লাসিক্যাল রেকর্ডের খুব ভালো কালেকশন ছিল আর সত্যজিৎ ওখানে প্রায়ই আসতো।
কখনও রেকর্ড নিতে, কখনও ফেরত দিতে। সত্যজিৎকে আমি চিনতাম ডিজে কিমার
কোম্পানির একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে। আমি তখন কিমার কোম্পানির জন্য
বিজ্ঞাপনের কপি লেখার টুকটাক কাজ করে দিতাম। এরপর দিলীপকুমার গুপ্ত যখন
সিগনেট প্রেস শুরু করলেন তখন সুকুমার রায়ের বইগুলিতে ওর ইলাস্ট্রেশান
দেখেছিলাম। একবার ওকে দিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদও আঁকিয়ে
ছিলাম। বইটার নাম দিয়েছিলাম ‘অগ্নিবর্ণ’। প্রুফ দেখতে গিয়ে কামাক্ষীপ্রসাদ
চট্টোপাধ্যায় প্রস্তাব দিলেন, নামটা পালটাও। ‘ছাড়পত্র’ রাখো। তাই হল। সত্যজিতের
ততদিনে প্রচ্ছদ আঁকা শেষ। আবার ওকে বসিয়ে নতুন করে প্রচ্ছদ আঁকা হয়েছিল।”

সত্যজিৎ-সুভাষ সম্পর্কের গোড়ার দিকে আরেক সেতুবন্ধের ভুমিকা নিয়েছিল
‘রংমশাল’ পত্রিকা। ১৩৫১ থেকে এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন কামাক্ষীপ্রসাদ
চট্টোপাধ্যায় ও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সিগনেট প্রেসে প্রথম যুগে কাজ করার সুবাদে
সত্যজিৎ ও দেবীপ্রসাদ একে অপরকে আগে থেকেই চিনতেন। তার আগেই ‘মৌচাক’
পত্রিকায় কামাক্ষীপ্রসাদের ‘অ্যাটাচি কেস’ গল্পের অলংকরণ ও ‘ছাতুবাবুর ছাতা’
বইএর প্রচ্ছদ করেছেন সত্যজিৎ। এর আগে রংমশালের প্রচ্ছদ করলেও ১৩৫৩ থেকে
পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যাতেই অলংকরণ ও বিভিন্ন বিভাগীয় নামাঙ্কনের মধ্যে সত্যজিতের
উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রথম জীবনে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘স্বাধীনতা’ ও ‘জনযুদ্ধ’
পত্রিকার জন্য রিপোর্টাজ লিখতেন, যার জন্য তাঁকে সারা বাংলার বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে
ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে হত। সেইসময় নানান ধরণের মানুষের সঙ্গে মিশে যে
বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, বন্ধু দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে সেইসব অভিজ্ঞতা ছোটদের জন্য সহজ সরল ভাষায় তিনি লিখতে লাগলেন রংমশালের পাতায়। ১৩৫৩-র বৈশাখ থেকে সত্যজিতের করা নামাঙ্কন-শোভিত ‘আমার বাংলা’ শিরোনামে সেই অনবদ্য লেখাগুলি রংমশালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।

এরপরে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনার এক অসাধারণ নিদর্শন আমরা পাই
১৯৫৫ সালে – ‘পাতাবাহার’ নামে ছোটদের এক বার্ষিকী প্রকাশিত হয় ন্যাশনাল বুক
এজেন্সি থেকে। সুভাষ সম্পাদিত এই সংকলনে ‘কলিকাতা কোথা রে’ নামে সুকুমার
রায়ের এক অগ্রন্থিত কবিতা ছাপা হয়েছিল, যার জন্য সত্যজিৎ কয়েকটি মজাদার
ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। সুকুমার ছাড়াও এই বার্ষিকীতে সুখলতা রাও, লীলা মজুমদার,
প্রেমেন্দ্র মিত্র, অন্নদাশংকর রায়, সমরেশ বসু ও আরও অনেক নামী সাহিত্যিক গল্প
ও কবিতা লেখেন। এই ১৯৫৫ সালেই মুক্তি পেল ‘পথের পাঁচালী’। সুভাষ জানাচ্ছেন
“এখনও মনে আছে, ডি জে কিমারে গেলেই দিলীপকুমার গুপ্ত সত্যজিতের পথের
পাঁচালির উচ্ছসিত প্রশংসা করতেন। তখন সবে শুটিং চলছে। স্টিল দেখাতেন শুটিং-
এর। আমি কি ছাই অত বুঝি! স্টিলগুলো নিছক ছবির বেশি কিছু মনে হয়নি।
অনেক পরে ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।” তখন থেকেই সত্যজিতের বন্ধু ও
অনুরাগী হিসেবে সুভাষ প্রায়ই সত্যজিতের বাড়ি গল্প করতে যেতেন।

এরপরের ঘটনা ১৯৬০। সুভাষের স্মৃতিচারণায় জানা যায় “একদিন মাসিমা
(সুপ্রভা রায়) ডেকে বললেন, ওকে বল না – রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে ছবি করতে।
আমি বললাম – কেন আপনিই তো বলতে পারেন। মাসিমা বলেছিলেন, তোমরা ওর
বন্ধু। নিশ্চয় তোমাদের কথা ও রাখবে। পরে সত্যজিতকে বলেছিলাম ঘটনাটা।
সত্যজিতও মায়ের এই দুর্বলতাটা জানত। বলেছিল, হ্যাঁ, আমি জানি। আমাকে করতেই
হবে।” রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্র ও ‘তিনকন্যা’ ছবির
প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন সত্যজিৎ। সেই সময়কার একদিনের ঘটনা সত্যজিৎ
জানাচ্ছেন – “একদিন আমার বন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় হঠাৎ বললেন যে
সন্দেশ-টাকে আবার বের করলে কেমন হয় । তা সেটা মনে ধরল ব্যাপারটা, এবং
তার ৬ মাসের মধ্যেই ১৯৬১তে সন্দেশ আমরা আবার নতুন করে বার করি ।”

সেই সময় সুভাষ-সত্যজিৎ সখ্যতার বিবরণ আমরা পাই সুভাষের ‘নিম নয়,
তিতা নয়’ প্রবন্ধে। ‘তিনকন্যা’ ছবির ‘সমাপ্তি’ পর্বের শুটিং হয়েছিল মুর্শিদাবাদের
নিমতিতায়। সুভাষ সেই শুটিং দলের সঙ্গী হয়ে গিয়ে নিমতিতার মানুষজন ও তাদের
রোজকার জীবনযাত্রা সম্পর্কে এই বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি লেখেন যা পরে তাঁর
‘ডাকবাংলার ডায়েরি’ বইতে সংকলিত হয়। সুভাষ ও সত্যজিতের সম্পাদনায়
সন্দেশের অফিস নেওয়া হয় ১৭২ নং ধর্মতলা স্ট্রীটে। সন্দেশ প্রকাশের গোড়ার দিকেরকথা জানাতে গিয়ে সুভাষ বলেছেন – “সন্দেশ যখন আবার বার করার কথা আমাদের মনে ওঠে তখন খুব একটা পরিষ্কার কোন ধারণা ছিল না নতুন সন্দেশের চেহারা সম্পর্কে। কিন্তু আমরা অনেক তোড়জোড় অনেক ভাবনাচিন্তা করেছিলাম।


যখন সন্দেশ বার হল সেটা প্রায় হঠাৎ করেই হয়ে গেল। আমরা অনেক হিসেবপত্র
করেছিলাম খরচের ব্যাপারেও। কাজে নেমে দেখা গেল তার কিছুই টিকলো না। কিন্তু
যেটা আমাদের মনে উৎসাহ জাগিয়েছিল আমার মনে হয়েছিল তা হল সন্দেশের
ব্যাপারে দারুন সাড়া পরে যাওয়াটা। কাগজে আমরা প্রথমে বিজ্ঞাপন দিই। এত
গ্রাহক হতে আরম্ভ করল যে তখন একেবারে শুরু করে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
…একদিন সত্যজিতের একটা কবিতা আমার হাতে এল। পড়ে মনে হল, ছন্দটা
ঢিলেঢালা। আরও পরে ভাবতে বসে অবাক হলাম। আমাদের কারবার তো ছন্দ, মিল
নিয়ে। নিয়মের ঘেরাটোপে ঘোরাফেরা। ওর মতো অমন স্বতঃস্ফুর্ততা কি নিজে
কবিতায় আনতে পারতাম? …আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল সত্যজিতের কবিতা ও
ছড়া। তার কারণ তাতে ছোটদের মনের দরজায় ঘা দিত। আমরাও লেখার চেষ্টা
করতাম। কিন্তু আমাদের লেখায় প্যাঁচপাকানো বেশি থাকত।” পুরনো সন্দেশের লেখা
ছাপানো ছাড়াও সম্পাদকরা অনেক নতুন লেখককে জায়গা দিয়েছিলেন যার ফলে ধীরে
ধীরে সন্দেশের নিজস্ব এক লেখক গোষ্ঠী তৈরি হতে পেরেছিল।

প্রথম সংখ্যাতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রথম ওরাং ওটাং
জেনিকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখলেন ‘জেনি মেমসাহেব নয়’। পরের বছর থেকে তিনি
সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেও সন্দেশের জন্য নানান ছড়া-গল্প-প্রবন্ধ লিখে
গেছেন। ১৯৭৩-এ প্রকাশিত ‘হাংরাস’ উপন্যাসটি সুভাষ উৎসর্গ করেন সত্যজিতকে।
সন্দীপ রায় জানালেন, “সুভাষকাকা একবার আমায় একটা বই উপহার দিয়ে খুব
মজার একটা ছড়া লিখে দিয়েছিলেন, যেটা আমার এখনও মনে আছে।”

কোন দেশ?
সন্দেশ।
কোন দ্বীপ?
সন্দীপ।
সন্দীপ রায়কে
এ বই দেয় কে?

কাঁচায় পাকা
সুভাষকাকা।

পরের দিকে দুজনের যোগাযোগ কমে এলেও পারস্পরিক সখ্যতা বরাবর বজায়
ছিল। সন্দেশের ঐতিহ্যকে সার্থকভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য
বাঙালি পাঠক এই দুই বন্ধুর কাছে চিরঋণী থাকবে।

লেখক পরিচিতি –

ঋদ্ধি গোস্বামী পেশায় অধ্যাপক, হেরিটেজ ইন্সটিটিউট অফ টেকনলজিতে জৈবপ্রযুক্তি
বিভাগে কর্মরত। চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ও সাহিত্য তাঁর আগ্রহের বিষয়। সত্যজিৎ রায়
সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত থেকে সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি সংরক্ষণ ও প্রকাশনার কাজে সাহায্য
করে থাকেন। তাঁর সম্পাদিত কয়েকটি বই – Travails with the Alien
(HarperCollins), 3Rays (Penguin), Satyajit Ray Miscellany (Penguin),
জলসাঘর (নিউ স্ক্রিপ্ট)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Click to Go Up
error: Content is protected !!